ব্যাংক খাতে আমানত প্রবৃদ্ধি কমছে

সময়: সোমবার, জুলাই ২৮, ২০২৫ ৮:৩০:৩১ অপরাহ্ণ

নিজস্ব প্রতিবেদক:

দেশের ব্যাংক খাতে সাম্প্রতিক আমানত প্রবৃদ্ধির ধারা থেমে আবার কমতে শুরু করেছে। একীভূতকরণ ও অবসায়নের গুঞ্জনে গ্রাহকদের মধ্যে নতুন করে উদ্বেগ তৈরি হওয়ায় আমানতকারীরা টাকা তুলে হাতে রাখছেন। এর প্রভাবে আমানত প্রবৃদ্ধি ৯ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২৫ সালের মে মাস শেষে ব্যাংক খাতে মোট আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২০ লাখ ১৮ হাজার ১৯৬ কোটি টাকা, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৮ দশমিক ৭৪ শতাংশ বেশি। তবে মার্চ মাসে এই প্রবৃদ্ধি ছিল ৯ দশমিক ৫১ শতাংশ, এরপর থেকে ধারাবাহিকভাবে কমেছে। মার্চ পর্যন্ত আমানত কমার তালিকায় ছিল ১১টি ব্যাংক, যা মে মাসে বেড়ে ১৬টিতে পৌঁছেছে।

প্রতিবেদনে বলছে, গত ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর কয়েকটি ব্যাংকের আর্থিক দুরবস্থা প্রকাশ পাওয়ায় আমানতকারীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এর ফলে আমানত প্রত্যাহারের চাপ বেড়ে যায়। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তারল্য সহায়তায় পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছিল, মে মাসে ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশ জারি হওয়ার পর একীভূতকরণ সংক্রান্ত অনিশ্চয়তায় নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়।

এক্সিম, সোস্যাল ইসলামী, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী, গ্লোবাল ইসলামী এবং ইউনিয়ন ব্যাংকসহ বেশ কয়েকটি ব্যাংকের একীভূতকরণের আলোচনা ও প্রকৃত আর্থিক পরিস্থিতি প্রকাশের আশঙ্কায় এই অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। অন্য কিছু ব্যাংকেও আমানত প্রত্যাহারের চাপ বৃদ্ধি পেয়েছে।

ঈদের মৌসুমে সাধারণত নগদ টাকার ব্যবহার বেড়ে যায়, তবে এবার তা রেকর্ড স্থাপন করেছে। গত ৫ জুন কোরবানি ঈদের আগে প্রচলনে থাকা নগদ টাকার পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ৩৯ হাজার ১৭৯ কোটি টাকা, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। এর আগের মাস মে মাসে নগদ টাকা ছিল ৩ লাখ ১৭ হাজার ৯৮৬ কোটি টাকা। গত বছরের কোরবানি ঈদের আগে নগদের পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ২৫ হাজার ৫৮৩ কোটি টাকা।

একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, “একীভূতকরণ বা অবসায়নের সিদ্ধান্ত দ্রুত ও স্পষ্ট না হলে সাধারণ মানুষের আস্থা কমে যায়। এটি ব্যাংক খাতের জন্য সংকট সৃষ্টি করতে পারে।”

অন্যদিকে, বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, মে মাস শেষে ব্যাংক খাতে ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ১৯ হাজার ৫৭২ কোটি টাকা, যা গত বছরের তুলনায় ৭ দশমিক ৩১ শতাংশ বেশি। ফলে ঋণ-আমানত অনুপাত (এডিআর) দাঁড়িয়েছে ৮১ দশমিক ০২ শতাংশে। তবে কিছু সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংকের ক্ষেত্রে এ অনুপাত অনেক বেশি।

যেসব ব্যাংকের আমানত সবচেয়ে বেশি কমেছে, তাদের মধ্যে রয়েছে— বেসিক ব্যাংক, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, মধুমতি ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক ও কমিউনিটি ব্যাংক। এছাড়া বিদেশি মালিকানাধীন আলফালাহ, স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া, উরি, হাবিব ও স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের আমানতও কমেছে। তবে বিদেশি ব্যাংকগুলো এলসি ও কমিশনভিত্তিক ব্যবসায় নির্ভরশীল হওয়ায় আমানত প্রবণতা তুলনামূলক কম থাকে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় অতীতের নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি, একক গ্রুপের বিপুল ঋণ গ্রহণ এবং খেলাপি ঋণের বৃদ্ধি মিলিয়ে ব্যাংক খাত চরম আস্থাহীনতায় পড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইতোমধ্যেই সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংকগুলোর জন্য প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার বিশেষ ঋণ প্রদান করেছে।

একীভূতকরণের জন্য নির্ধারিত পাঁচ ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৪৭ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছেছে, যা তাদের মোট ঋণের প্রায় ৭৭ শতাংশ।

Print This Post