ব্যাংকগুলোর করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা (সিএসআর) খাতে ব্যয় কমে অর্ধেকে নেমেছে। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে অর্থাৎ জানুয়ারি-জুন সময়ে ব্যাংকগুলো সিএসআরে ব্যয় হয়েছে ১৫১ কোটি টাকা। গত বছরের একই সময়ে যা ছিল ৩০৯ কোটি টাকা। এর আগে ২০২৩ সালের প্রথম ছয় মাসে ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ৫৭১ কোটি টাকা। মূলত ব্যাংকগুলোর প্রকৃত চিত্র সামনে আসতে শুরু করায় আগের মতো আর মুনাফা দেখাতে পারছে না। যে কারণে এ খাতে ব্যয় কমেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০২৪ সালে আগের মতো খেলাপি ঋণ নিয়মিত দেখিয়ে মুনাফা দেখানোর সুযোগ পায়নি ব্যাংক। যে কারণে সামগ্রিকভাবে মুনাফা কমেছে। ঋণের বিপরীতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি ও কর পরিশোধের পর নিট লোকসানে পড়েছে ১৭টি ব্যাংক। এ তালিকায় রয়েছে সরকারি মালিকানার জনতা, অগ্রণী, বেসিক, বাংলাদেশ কৃষি ও রাজশাহী উন্নয়ন ব্যাংক। আছে বেসরকারি খাতের ইসলামী
ব্যাংক বাংলাদেশ, সোস্যাল ইসলামী, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী, গ্লোবাল ইসলামী, ইউনিয়ন, বাংলাদেশ কমার্স, ন্যাশনাল, এনআরবি কমার্শিয়াল, পদ্মা, আইএফআইসি, এবি এবং আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক।
বিদ্যমান নিয়মে কোনো ব্যাংক নিট লোকসানে থাকলে সিএসআর খাতে কোনো ব্যয় করতে পারবে না। আর নিট মুনাফায় থাকলে একটি অংশ সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে ব্যয় করা যাবে। কোনো ব্যাংক মুনাফার কত অংশ ব্যয় করবে বা আদৌ করবে কিনা তা তাদের নিজস্ব বিষয়।
কোনো ব্যাংক সিএসআর ব্যয় করলে তার অনুপাত কী হবে তা কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নির্ধারণ করে দেওয়া আছে। বাংলাদেশ ব্যাংক নির্ধারিত নিয়ম অনুযায়ী, একটি ব্যাংক ১০০ টাকা সিএসআর ব্যয় করলে তার মধ্যে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ৩০ শতাংশ করে মোট ৬০ শতাংশ খরচ করতে হবে। পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন খাতে ২০ শতাংশ ব্যয় করতে হবে। বাকি ২০ শতাংশ আয়-উৎসারী কাজ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, অবকাঠামো উন্নয়ন, ক্রীড়া ও সংস্কৃতি এবং অন্যান্য খাতে খরচ করা যাবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে, অধিকাংশ ব্যাংক এই নিয়ম না মেনে বড় অংশ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার আওতায় বেশির ভাগ অর্থ দিয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই ত্রাণ তহবিলের বড় অংশই সরকারপ্রধানের তহবিলে দেওয়া হয়। বিগত সরকারের সময়ে এ উপায়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ত্রাণ তহবিলে অর্থ দেওয়া নিয়ে সমালোচনা ছিল। এখনও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাতে সিএসআরের সবচেয়ে
বেশি অর্থ ব্যয় করছে ব্যাংকগুলো।
চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে মোট সিএসআর ব্যয়ের মধ্যে ৭৫ কোটি ১০ লাখ টাকা বা ৪৯ দশমিক ৮৮ শতাংশ গেছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা খাতে। গত বছর এ খাতে ব্যয় হয় ১৩৮ কোটি টাকা বা মোট ব্যয়ের ৪৪ দশমিক ৬৪ শতাংশ। এ বছর স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় কমে ২৮ কোটি টাকা বা ১৮ দশমিক ৬৭ শতাংশে নেমেছে। আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৭২ কোটি টাকা বা ২৩ দশমিক ২৮ শতাংশ। পরিবেশ এবং জলবায়ু খাতে ৫ কোটি ২১ লাখ বা ৩ দশমিক ৪৬ শতাংশ। আগের বছরের একই সময়ে যা ছিল সাত কোটি ৩৫ লাখ টাকা বা ২ দশমিক ৩৮ শতাংশ। ক্রীড়া ও সংস্কৃতি খাতে ব্যয় হয়েছে তিন কোটি ৬৪ লাখ টাকা বা ২ দশমিক ৪২ শতাংশ। বাকি অর্থ ব্যয় হয়েছে অন্যান্য খাতে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংক খাতের মধ্যে গত বছর সর্বোচ্চ নিট মুনাফা করেছে বিদেশি মালিকানার স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক। ব্যাংকটির মুনাফার পরিমাণ ছিল তিন হাজার ৩০০ কোটি টাকা। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্র্যাক ব্যাংকের নিট মুনাফা হয়েছে এক হাজার ২১৪ কোটি টাকা। সিটি ব্যাংক এক হাজার ৮৫ কোটি টাকা মুনাফা করে তৃতীয় অবস্থানে ছিল। আর চতুর্থ অবস্থানে থাকা বিদেশি মালিকানার এইচএসবিসি এক হাজার ৭৯ কোটি টাকার মুনাফা করেছে। দীর্ঘদিন পর মুনাফায় পঞ্চম অবস্থানে উঠে এসেছে রাষ্ট্রীয় মালিকানার সোনালী ব্যাংক। গত বছর ব্যাংকটির নিট মুনাফা ছিল ৮৬৬ কোটি টাকা। শীর্ষ ১০ ব্যাংকের তালিকায় থাকা পূবালী ব্যাংক ৭৬২ কোটি, ইস্টার্ন ব্যাংক ৭৫০ কোটি, প্রাইম ব্যাংক ৭৪৫ কোটি, কমার্শিয়াল ব্যাংক অব সিলন ৬০০ কোটি ও উত্তরা ব্যাংক ৪৮৮ কোটি টাকা মুনাফা করেছে।
আগের বছরের নিট মুনাফার ভিত্তিতে পরবর্তী বছর সিএসআর খাতে ব্যয় করতে হয়। গত বছর মুনাফার শীর্ষে থাকা ব্যাংকই যে বেশি সিএসআর করে তেমনটি না। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে সিএসআর খাতে সর্বোচ্চ ২৪ কোটি টাকা ব্যয় করেছে মার্কেন্টাইল ব্যাংক। এরপর রয়েছে পর্যায়ক্রমে শাহজালাল ইসলামী ১৪ কোটি, যমুনা ব্যাংক ১২ কোটি, প্রিমিয়ার ১১ কোটি, পূবালী ৯ কোটি ৮০ লাখ, এক্সিম সাত কোটি, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ ছয় কোটি ৬৮ লাখ, ডাচ্-বাংলা ছয় কোটি ৬৫ লাখ, আল-আরাফাহ্ ইসলামী ছয় কোটি ৩০ লাখ এবং ঢাকা ব্যাংক ছয় কোটি ১৯ লাখ টাকা।

