দেশের চালের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে। ধানের বাম্পার ফলন, সন্তোষজনক সরবরাহ ব্যবস্থা, আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দাম কমেছে। সারসহ কৃষি উপকরণের দামও নিম্নমুখী। মূল্য কমার এমন অনুকূল পরিবেশেও দেশের বাজারে বেপরোয়া গতিতে বাড়ছে চালের দাম। অজুহাত দেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন অঞ্চলে একাধিকবার বন্যা, টানা বর্ষণসহ নানা বিষয়। দেশ-বিদেশের তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, চালের দাম এখন কমার কথা। কিন্তু দাম তো কমছেই না, উলটো বাড়ছে। দফায় দফায় দাম বেড়ে ‘রেড জোন’ বা লাল তালিকায় চলে গেছে চাল। সাম্প্রতিক সময়ে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে (চলতি বছরের আলোচিত মাসের সঙ্গে গত বছরের একই মাসের তুলনায়) প্রতি মাসে গড়ে চালের দাম বাড়ছে ১০ শতাংশের বেশি। গত ১২ মাসের হিসাবের মধ্যে ৯ মাসই চালের দাম ১০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। বাকি ৩ মাস দাম বেড়েছে ১০ শতাংশের কম।
এদিকে চালের দাম মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধির কারণে ভোক্তার খরচ বাড়ছে। দেশের স্বল্প ও মধ্যম আয়ের বেশির ভাগ ভোক্তার প্রধান খাদ্য চাল। তাদের জীবনযাত্রার মোট খরচের মধ্যে ৪৪ দশমিক ২০ শতাংশ যায় খাদ্যের পেছনে। এর মধ্যে ১০ দশমিক ৮০ শতাংশ খরচ করে চাল কিনতে। একক পণ্য হিসাবে চাল কেনায় ভোক্তা বেশি অর্থ ব্যয় করেন। এ কারণে চালের দাম বাড়লে ভোক্তার জীবনযাত্রার মানে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) এই তিন সরকারি সংস্থার তথ্য বিশ্লেষণ করে চালের দামের এমন চিত্র পাওয়া গেছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) মূল্যস্ফীতির হার নিরূপণের জন্য বিভিন্ন বাজার থেকে নিত্যপণ্যের দামের যেসব তথ্য সংগ্রহ করে তা নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজস্ব পদ্ধতিতে মূল্যস্ফীতির উত্তাপের নকশা তৈরি করেছে। ওই নকশায় কোনো পণ্যের দাম কোনো মাসে গড়ে ১০ শতাংশের বেশি বাড়লে তা লাল তালিকায় বা রেড জোনে ফেলা হয়। ৮ শতাংশের বেশি থেকে ১০ শতাংশের মধ্যে বাড়লে হালকা লালে, ৬ শতাংশের বেশি থেকে ৮ শতাংশের মধ্যে বাড়লে লাল-সবুজের মিশ্রণের অঞ্চলে, ৪ শতাংশের বেশি থেকে ৬ শতাংশের মধ্যে বাড়লে সবুজাভাব অঞ্চলে, ২ শতাংশের বেশি থেকে ৪ শতাংশের মধ্যে বাড়লে হালকা সবুজ ও শূন্য থেকে ২ শতাংশের মধ্যে বাড়লে সবুজ রংয়ে ফেলা হয়। কোনো পণ্যের দাম কমলেও তাকে গাঢ় সবুজ রংয়ের মধ্যে ফেলা হয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তৈরি ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে গত বছরের অক্টোবর, ডিসেম্বর, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত এই ৫ মাস চালের দাম বেড়েছে ১০ শতাংশের বেশি। ফলে ওই সময়ে চাল ছিল লাল তালিকায়। এর মধ্যে চলতি বছরের মার্চে বাড়ে ১২ দশমিক ৬ শতাংশ, ফেব্রুয়ারিতে ১৩ দশমিক ৫ শতাংশ, জানুয়ারিতে ১৪ দশমিক ৭ শতাংশ, গত বছরের ডিসেম্বরে ১১ দশমিক ৮ শতাংশ ও অক্টোবরে বাড়ে ১০ দশমিক ৬ শতাংশ। ওই সময়ের মধ্যে শুধু নভেম্বরে বাড়ার হার কিছুটা কমে ৯ দশমিক ৮ শতাংশ হয়।
চালের দাম বৃদ্ধি প্রসঙ্গে ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএম) নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তফা কে মুজেরী বলেন, চালের উৎপাদন ভালো হয়েছে, বড় কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়নি এরপরও সরকারিভাবে চাল আমদানি করা হয়েছে। কিন্তু দাম কমছে না। এর অর্থ হলো সরবরাহ বাড়িয়ে দাম কমানো যাবে না। কারণ এখানে মূল সমস্যা বাজার ব্যবস্থাপনা। চালের বাজারে মূল্য নিয়ন্ত্রণ হলো আড়তদার ও মিলারদের হাতে। যতই সরবরাহ স্বাভাবিক থাকুক না কেন তারা সিন্ডিকেট করে দাম নিয়ন্ত্রণ করবেই। এজন্য সরকারকে মূল জায়গায় হাত দিতে হবে। যে কাজটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার করতে পারেনি। ফলে চালের বাজারে অস্থিরতা থেকেই যাচ্ছে। তাই গরিব মানুষের আয় শেষ হচ্ছে চাল কেনার পেছনে। আবার কম ভাত খাওয়ায় তারা প্রয়োজনীয় ক্যালোরিও নিতে পারছেন না।
এদিকে টিসিবির প্রতিদিনের বাজারদরের তথ্য থেকে মাঝারি মানের চালের সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তথ্য সংগ্রহ করে তার গড় করে দেখা যায়, পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত টানা ৪ মাস চালের দাম বেড়েছে ১০ শতাংশের বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে গত বছরের জুলাইয়ে চালের দাম বেড়েছিল ১ দশমিক ৩ শতাংশ। জুনে কমেছিল দশমিক ৮ শতাংশ। মে মাসে বেড়েছিল দশমিক ৫ শতাংশ। গত বছরের এপ্রিলে চালের দাম কমেছিল ৩ দশমিক ৮ শতাংশ। প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, চালের ভরা মৌসুমেও দাম বেড়েছে। বাজার ব্যবস্থাপনার ত্রুটির কারণেই দাম বেড়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এ কারণে বাজার ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা আনতে সরকারের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন বলে মন্তব্য করা হয়েছে।
এদিকে গত বছরের আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তিন দফায় অপ্রত্যাশিত বন্যা, রাজনৈতিক অস্থিরতায় উৎপাদন কিছুটা বাধাগ্রস্ত হলেও সার্বিকভাবে আগের বছরের তুলনায় উৎপাদন বেড়েছে। কৃষি খাতের প্রধান ফসল যেমন ধান, গম, ভুট্টা, আলু এবং শাকসবজির উৎপাদন বেড়েছে। অনুকূল আবহাওয়ার কারণে বোরো ধান উৎপাদনে বাম্পার ফলন হয়েছে। আমন ধানের উৎপাদন ১ কোটি ৭২ লাখ টন ছাড়িয়েছে। আউশের উৎপাদন ৬ শতাংশ কমেছে। ৩৮ লাখ টন লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে উৎপাদন হয়েছে ২৮ লাখ টন।
এদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দাম কমছে। গত বছরের সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে প্রতি টন চালের দাম ছিল ৬০০ ডলারের বেশি। মার্চ প্রান্তিকে তা আরও বেড়ে ৬৩২ ডলার ছাড়িয়ে যায়। এরপর থেকে কমতে থাকে। জুন প্রান্তিকে ৬১৭ ডলারে নেমে আসে। গত মার্চ প্রান্তিকে তা আরও কমে ৪৪৭ ডলারে নেমে যায়। জুন প্রান্তিকে আরও কমে ৪৪৫ ডলারে নামে। তারপরও দেশে চালের দাম বাড়ছে।

