রাস্তার এক পাশে সারি সারি কাভার্ড ভ্যান থামানো, অন্য পাশে আড়ত। দুই পাশেই চলছে ফল বেচাকেনা। কেউ পাইকারি দামে ফল বিক্রি করছেন, ব্যস্ত ফলের নিলাম নিয়ে। সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল ছাড়িয়ে আহসান মঞ্জিল পর্যন্ত শুধু মানুষের হাঁকডাক। এমনই চিত্র বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত বাদামতলী বাজারের। দেশে ফল বিক্রির সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার এটি। মাল্টা, আপেল, কমলা, আঙুর থেকে শুরু করে সব ধরনের ফলই পাওয়া যাই এই পাইকারি বাজারে। আছে দেশীয় অনেক ফলও। প্রায় শতবর্ষ পুরোনো এই বাজারে প্রতিদিন ফল বেচাকেনা করে প্রায় শতকোটি টাকা লেনদেন হয়।
ব্যবসায়ীরা জানান, মূলত কাকডাকা ভোরেই শুরু হয় এই বাজারের কার্যক্রম। সমুদ্রবন্দর ও বিভিন্ন স্থলবন্দর থেকে আমদানি করা ফল নিয়ে একের পর এক আসতে শুরু করে কাভার্ড ভ্যান। সকাল ছয়টা থেকে সাধারণ ক্রেতাদের আনাগোনাও বাড়তে থাকে এই বাজারে। এভাবে ক্রেতা–বিক্রেতার উপস্থিতিতে ভোর থেকে জমে ওঠে পাইকারি ফল বেচাকেনা। এই বেচাকেনা চলে দুপুরের পর পর্যন্ত। পুরো সময়টায় আড়তদার, পাইকারি ক্রেতা, খুচরা ব্যবসায়ী মিলিয়ে লক্ষাধিক লোক এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকেন।
বাজারের গোড়াপত্তন
ঢাকার প্রধান আড়তগুলোর মধ্যে বাদামতলী অন্যতম। ব্রিটিশ আমল থেকেই পাইকারি ব্যবসার জন্য পুরান ঢাকার শ্যামবাজার, মৌলভীবাজার বা ইমামগঞ্জের মতো বাদামতলীও প্রসিদ্ধ ছিল। তবে এই বাজারে ঠিক কবে থেকে পাইকারি ফল বেচাকেনা শুরু হয়, তা সঠিকভাবে জানা যায়নি।
ফল ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, ব্রিটিশ শাসনের শেষ দিকে ও পাকিস্তান আমলে এখানে ফল বেচাকেনার বড় পাইকারি বাজার গড়ে ওঠে। বাংলাপিডিয়ার তথ্য অনুসারেও বাদামতলী ফলের বাজারের গোড়াপত্তন ব্রিটিশ আমলে, ১৯৩৫ সালের দিকে। তখন চার থেকে পাঁচজন ব্যবসায়ী মিলে এই স্থানে ফলের পাইকারি ব্যবসা শুরু করেন। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত স্থানীয় মৌসুমি ফল এবং ভারত ও পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আনা কিছু ফল বিক্রি হতো বাজারটিতে। স্বাধীনতার পর বাজারটির ধরন বদলে যায়। নতুন নতুন ব্যবসায়ী যুক্ত হন এই বাজারে। পর্যায়ক্রমে দেশীয় ফলের বদলে আমদানি করা ফলের বড় বাজারে পরিণত হয় বাদামতলী।
বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক নুরুদ্দিন আহমেদ বলেন, স্বাধীনতার পরে স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে ফল আমদানি করা হতো, সেই ফল আসত বাদামতলী বাজারে। পরে এখান থেকে দেশের অন্যান্য অঞ্চলে যেত। প্রযুক্তি ও সময়ের আবর্তে আমদানির ধরন বদলেছে। বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ফল আমদানি করা হয়। এর বেশির ভাগই আসে চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে। আমদানি করা এসব ফলের বড় অংশ এখন অনলাইনে আগাম বেচাকেনা হয়। ফলে চট্টগ্রাম বন্দর থেকেই দেশের বিভিন্ন স্থানে সেগুলো চলে যায়। এ জন্য বাদামতলী বাজারের বেচাকেনা কিছুটা কমেছে। যদিও বিক্রেতা ও ক্রেতার সংখ্যা বাড়ায় ব্যবসার পরিধি বেড়েছে। কারণ, আড়তদার কমেছে; বিপরীতে বেড়েছে পাইকারি ও মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ী। আড়তগুলো এখন মূলত পাইকারি দোকান হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
বাজার কত বড়
বাদামতলী ফলবাজারে প্রধানত তিন ধরনের ব্যবসায়ী আছেন। এক. আমদানিকারক; দুই. ফড়িয়া ও মধ্যবর্তী ব্যবসায়ী; এবং তিন. পাইকারি ব্যবসায়ী। বিদেশি ফল আমদানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা জানিয়েছেন, বাদামতলীকেন্দ্রিক তাঁদের সংগঠনের সদস্যসংখ্যা পাঁচ শতাধিক। এর মধ্যে বড় আমদানিকারকের সংখ্যা এক শর মতো। আর ফড়িয়া ও পাইকারি বিক্রেতার দোকানের সংখ্যা পাঁচ শতাধিক। এ ছাড়া এখানে ৮-১০টি বড় ফল রাখার হিমাগার রয়েছে। আরও আছে ফল বিক্রির জন্য কাগজের প্যাকেট বিক্রির মতো ছোটখাটো কিছু ব্যবসাও।
বাদামতলীর বাজারের লেনদেনের হিসাব করতে হলে মূলত ফড়িয়া ও পাইকারি বেচাকেনার হিসাব করতে হবে, এই সংখ্যা পাঁচ শতাধিক। ব্যবসায়ীরা জানান, এখানে প্রতিটি দোকানে দিনে ৩০–৪০ লাখ টাকার ফল বেচাকেনা হয়। সেই হিসাবে পাঁচ শতাধিক পাইকারি ও ফড়িয়া বিক্রেতার হাত ধরে এই পাইকারি বাজারে প্রতিদিন অন্তত ১৫০-২০০ কোটি টাকার ফল বেচাকেনা হয়।
বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম বলেন, ব্যবসায় মন্দা গেলে বেচাকেনাও কমে যায়। তখন প্রতিদিন লেনদেন ৫০-৬০ কোটি টাকায় নেমে আসে। বর্তমানে উচ্চ শুল্ক–করের কারণে ব্যবসায় মন্দা যাচ্ছে বলে দাবি করেন তিনি।
বাদামতলীর ফল ব্যবসায়ীরা জানান, খেজুর বাদে দেশে বছরে দুই থেকে আড়াই লাখ টন ফল আমদানি করা হয়। আর খেজুর আমদানি করা হয় ৮৫-৯০ হাজার টন। এই বাজারে মাল্টা, আপেল, কমলা, আঙুরের মতো কিছু ফল সারা বছরই পাওয়া যায়। দেশে সবচেয়ে বেশি আমদানি করা হয় মাল্টা। বেশির ভাগ মাল্টা আসে মিসর, দক্ষিণ আফ্রিকা ও চীন থেকে। এরপর বেশি আমদানি হয় আপেল ও কমলা। এই দুটি ফল বেশি আসে চীন, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ভারত থেকে। আর আঙুর বেশি আসে চীন ও ভারত থেকে। দেশে আমদানি করা মোট ফলের ৬০-৭০ শতাংশই এই চার ফলের দখলে।
এ ছাড়া ভারত ও মিসর থেকে বেদানা, চীন থেকে নাশপাতি আসে। আবার অ্যাভোকাডো, চেরি প্রভৃতি ফলও এ বাজারে পাওয়া যায়। এগুলো অবশ্য আকাশপথে বেশি আসে। আর সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে খেজুর আমদানি করা হয়। মৌসুমভেদেও ফলের ভিন্নতা থাকে। যেমন মাল্টার কথা ধরা যাক। বছরের জানুয়ারি থেকে জুন মাসে মাল্টা আসে মিসর থেকে। আবার জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে এবং আগস্ট থেকে অক্টোবর মাসে ভারত থেকে মাল্টা আসে।
দরদাম কেমন
দরদাম নিয়ে জিজ্ঞেস করতেই বাদামতলীর পাইকারি বিক্রেতা জসিম আহমেদ জানালেন, ফল পচনশীল পণ্য। তাই দাম প্রতিদিনই ওঠানামা করে। সাধারণত পাইকারি হিসাবে কার্টন, বাক্স বা ক্যারেট হিসেবে এখানে ফল বিক্রি করা হয়। যেমন প্রতি কার্টনে ১৫-১৬ কেজি মাল্টা থাকে, আঙুর থাকে ৬-৭ কেজি, আর কমলা থাকে ১২-১৩ কেজি।
বাদামতলী বাজার ঘুরে দেখা গেছে, পাইকারিতে এক কার্টুন মাল্টা ৩ হাজার ৩০০ টাকা থেকে ৩ হাজার ৬০০ টাকার মধ্যে বিক্রি হয়। তাতে এক কেজি মাল্টার পাইকারি দাম হয় ২২০-২৪০ টাকা। এভাবে পাইকারিতে সবুজ আপেল ২৪০-৩৬০ টাকা ও লাল আপেল ২০০-২৫০, আঙুর ৩৫০-৪০০, কমলা ২২০-২৫০, আনার ৩৫০-৪০০, নাশপাতি ২০০-২২০, ড্রাগন ১২০-১৭০ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়। ফলের বিভিন্ন মান থাকে। মান কম হলে দামও কম হয়।
অন্যদিকে বর্তমানে খুচরা বাজারে প্রতি কেজি মাল্টা ২৫০-২৮০ টাকা, কমলা ৩০০-৩২০, সবুজ আপেল ৩৮০-৪০০, লাল আপেল ৩০০-৩৬০, আনার ৪৫০-৫৫০, আঙুর ৪০০-৬০০, নাশপাতি ৩২০-৩৪০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। বাজার ও ফলের মানভেদে দামও কমবেশি হয়।
বাদামতলী বাজারের আরেকটি দিক হচ্ছে, নিলামে ফল বিক্রি। যেসব ফল বিক্রি হতে অনেক দিন লেগে যায়, সেগুলো দ্রুত নিলামে বিক্রি করে দেন ব্যবসায়ীরা। এ ক্ষেত্রে পাইকারির চেয়ে তুলনামূলক কম দামে বিক্রি করা হয়। নিলামের ব্যবসায়ী আবার আলাদা। তাঁরা নগদ টাকায় ফল কিনে নগদ টাকায় বিক্রি করেন।
ফল আমদানিকারক সমিতির সভাপতি সিরাজুল ইসলাম জানান, বর্তমানে ফল আমদানিতে প্রচুর প্রতিযোগী রয়েছে। আর শুল্কও বেশি। এ কারণে লাভ কমে গেছে। এ ছাড়া বাদামতলী বাজারের অন্যতম প্রধান সমস্যা যাতায়াত। সরু রাস্তার কারণে এই বাজারে কাভার্ড ভ্যান প্রবেশে অসুবিধা হয়। সকাল আটটার মধ্যে প্রবেশ না করলে ওই কাভার্ড ভ্যান পুরো এক দিন অপেক্ষা করতে হয়। তাতে আর্থিক ক্ষতি হয় ব্যবসায়ীদের। এ ছাড়া হিমাগারের সংখ্যাও অপ্রতুল।

