ঘুম ভেঙে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে অনেকেই দিন শুরু করেন। ব্যস্ত নগরজীবনে ক্লান্তিকে ছুটি দিতেও চায়ের জুড়ি মেলা ভার! ঝামেলাহীন ও সাশ্রয়ী হওয়ায় চা-প্রেমীদের প্রথম পছন্দ একবার ব্যবহারের চায়ের ব্যাগ (টি ব্যাগ)। অথচ এক কাপ চায়ে স্বস্তি খুঁজতে থাকা মানুষ অজান্তেই শরীরে নিচ্ছেন ‘বিপজ্জনক ভারী ধাতু’। সহজে বললে টি ব্যাগের মাধ্যমে পান করছেন কাপভর্তি বিষ!
বেসরকারি সংস্থা এনভায়রনমেন্ট ও সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (এসডো) দাবি, তারা দেশের বাজারে বিক্রি হওয়া জনপ্রিয় টি ব্যাগে ‘বিপজ্জনক ভারী ধাতু’র উপস্থিতি পেয়েছে।
এসডোর ‘ব্রিউইং টক্সিনস: এক্সপোজিং দ্য হেভি মেটাল হ্যাজার্ড ইন টি-ব্যাগস অ্যান্ড ড্রাইয়ে লুজ টি’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্থানীয় বাজার থেকে সংগ্রহ করা ১৩টি নমুনার (১২টি ব্যাগ ও চা পাতা) ল্যাব পরীক্ষায় টি ব্যাগে বিপজ্জনক মাত্রায় ভারী ধাতুর উপস্থিতি মিলেছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর লালমাটিয়ায় এসডোর প্রধান কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে গবেষণার ফল প্রকাশ করে বলা হয়, নমুনা হিসেবে নেওয়া টি ব্যাগে নিরাপদ মাত্রার চেয়ে বহুগুণ বিপজ্জনক ভারী ধাতু রয়েছে। অধিকাংশ মানুষের দিনে একাধিকবার চা পানের অভ্যাসের কারণে এটি ভয়ানক স্বাস্থ্যঝুঁকির ইঙ্গিত দিচ্ছে।
অতীতে নানা গবেষণায় চাল, বেগুন, পালংশাক, মুরগি ও গরুর মাংস, রুই, তেলাপিয়া মাছসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্যে ভারী ধাতুর উপস্থিতি মিলেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষের খাদ্যচক্রে এসব ভারী ধাতুর প্রভাব তাৎক্ষণিকভাবে দৃশ্যমান না হলেও দীর্ঘ মেয়াদে বড় ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হতে পারে। নির্দিষ্ট কোনো ফসল বা খাদ্যপণ্য নিয়ে আতঙ্কিত না হয়ে উৎপাদনের উৎসে বিষ ছড়ানোর সুযোগ বন্ধে উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।
এসডো গবেষণার ক্ষেত্রে দুটি ধাপ অনুসরণ করে। জনগণের সচেতনতা বোঝার জন্য ভোক্তা জরিপ এবং এক্স-রে ফ্লুরোসেন্স প্রযুক্তির মাধ্যমে ল্যাবে ধাতুর মাত্রা নির্ধারণ।
প্রতিবেদনে বলা হয়, পরীক্ষায় টি ব্যাগে ক্রোমিয়াম সর্বোচ্চ ১ হাজার ৬৯০ পিপিএম মিলেছে, যা নিরাপদ সীমার (৫ পিপিএম) চেয়ে প্রায় ৩৩৮ গুণ। পারদ পাওয়া গেছে নিরাপদ সীমার (০.৩ পিপিএম) প্রায় ৩৬০ গুণ। একইভাবে সিসা ৫১ পিপিএম (সিমা ৫ পিপিএম) ও আর্সেনিক ১৪ পিপিএম (সিমা ২ পিপিএম) পাওয়া গেছে।
টি ব্যাগে এ ধরনের ভারী ধাতুর উপস্থিতি নিয়মিত চা পানকারীদের জন্য গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করছে বলে গবেষকরা মনে করছেন। এসডোর নির্বাহী পরিচালক সিদ্দীকা সুলতানা বলেন, চায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা না গেলে এটি মানুষের জন্য শারীরিক ঝুঁকির সঙ্গে মানসিক চাপও তৈরি করবে।
বাংলাদেশ চা বোর্ডের গবেষণা কর্মকর্তা নাজমুল আলম বলেন, ‘গবেষণাটি আমাদের জন্য অত্যন্ত উদ্বেগের। টি ব্যাগ এত ঝুঁকি বহন করে– আমরা আগে জানতাম না। তবে গবেষণায় সরকারি অংশীদারদের সংযুক্ত করলে ভালো হতো। আশা করছি, ভবিষ্যতে অংশগ্রহণমূলক গবেষণা হবে।
গবেষণায় টি ব্যাগ থেকে চা পাতা আলাদা করার পর ভারী ধাতু অ্যান্টিমনি পাওয়া গেছে সর্বোচ্চ ১৫৪ পিপিএম। নগণ্য পরিমাণে মিলেছে ইউরেনিয়াম ও থোরিয়াম। পাশাপাশি সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে কার্যকরী আয়রন, ম্যাঙ্গানিজ, কপার, জিঙ্ক ও কোবাল্টের মতো প্রয়োজনীয় উপাদানও পাওয়া গেছে।
বৈজ্ঞানিক গবেষণার পাশাপাশি জাতীয় পর্যায়ে তিন হাজার ৫৭১ জনের মতামত নেয় এসডো। এতে সাধারণ মানুষের চা পানের অভ্যাস ও কেনার বিষয়ে সচেতনতার চিত্র উঠে এসেছে। গবেষণায় বলা হয়, ৫৫ শতাংশ মানুষ দিনে ২-৩ কাপ চা পান করেন। ২৭ শতাংশ মানুষ প্রতিদিন চার বা তারও বেশি কাপ চায়ের স্বাদ নেন। মোট উত্তরদাতার মধ্যে মাত্র এক শতাংশ মানুষ ধারণা রাখেন, টি ব্যাগে ভারী ধাতু থাকতে পারে।
বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই), পরিবেশ অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ খাদ্য নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষ গবেষণাকে স্বাগত জানিয়েছে। বলেছে, গুরুত্বপূর্ণ প্রাথমিক তথ্য আরও গবেষণার দরজা খুলে দিয়েছে।
বিএসটিআইর সহকারী পরিচালক ইসমাত জাহান বলেন, ‘আমরা দ্রুত সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করব। আমাদের অবশ্যই দেশীয় চা শিল্প টিকিয়ে রাখা ও বিকশিত করার চেষ্টা করতে হবে।’
এসডোর সিনিয়র টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজার শাহরিয়ার হোসেন বলেন, ‘খাদ্য শৃঙ্খলে বিষাক্ত ভারী ধাতু প্রবেশ করার পথ রোধ করার জন্য গবেষণা গুরুত্বপূর্ণ সূচনা। তবে এর উদ্দেশ্য কাউকে দোষারোপ নয়, বরং যৌথভাবে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করা।’ সংস্থার চেয়ারম্যান সৈয়দ মার্গুব মোরশেদ বলেন, ‘এটি ভোক্তা অধিকারের গুরুতর লঙ্ঘন। অবিলম্বে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানাই।’