- Trade News 24 - https://www.tradenews24.com -

বিএসইসির তদন্তের জালে এলআর গ্লোবাল: অভিযোগ অর্থপচার ও অবৈধ বিনিয়োগ

পুঁজিবাজারের সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি এলআর গ্লোবাল বাংলাদেশ অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি লিমিটেডকে ঘিরে নানান অনিয়ম, আইন লঙ্ঘন, দুর্বল ব্যবস্থাপনা ও বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ ক্ষুন্ন করার অভিযোগ রয়েছে। বিশেষ করে কোম্পানিটির পরিচালিত ছয়টি মিউচুয়াল ফান্ডের অর্থ বিধিবহির্ভূতভাবে বিনিয়োগ এবং আত্মসাৎ করে বিদেশে পাচার করার মতো গুরুত্বর অভিযোগ রয়েছে।

এমন পরিস্থিতিতে কোম্পানিটির সার্বিক কার্যক্রম অনুসন্ধান করে দেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।

এরই ধরাবাহিকতায় ১৬টি শর্ত পরিপালন সাপেক্ষে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। গঠিত তদন্ত কমিটিকে ৬০ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত কার্যক্রম সম্পন্ন করে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন বিএসইসিতে দাখিল করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

এ সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি কোম্পানিটির প্রধান বিনিয়োগ কর্মকর্তার (চিফ ইনভেস্টমেন্ট অফিসার) দায়িত্বে রয়েছেন রিয়াজ ইসলাম। আর কোম্পানিটির উপদেষ্টার হিসেবে রয়েছেন সাবেক সংসদ সদস্য ও বিশ্বসেরা ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান ও বিশিষ্ট ক্রীড়া সাংবাদিক রেজাউর রহমান সোহাগ।

সম্প্রতি বিএসইসির মার্কেট ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত একটি আদেশ জারি করা হয়েছে।

তদন্তের বিষয়টি এলআর গ্লোবাল বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রিয়াজ ইসলামকে অবহিত করা হয়েছে। এছাড়া বিএসইসির সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্যরা হলেন- বিএসইসির অতিরিক্ত পরিচালক শেখ মো. লুৎফুল কবির, উপ-পরিচালক এস. এম. আহসানুল কবির এবং সহকারী পরিচালক মো. মতিউর রহমান।

এলআর গ্লোবাল বাংলাদেশ অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের পরিচালিত মিউচুয়াল ফান্ডগুলো হলো- (১) ডিবিএইচ ফার্স্ট মিউচুয়াল ফান্ড (২) গ্রিন ডেল্টা মিউচুয়াল ফান্ড (৩) এআইবিএল ফার্স্ট ইসলামিক মিউচুয়াল ফান্ড (৪) এলআর গ্লোবাল বাংলাদেশ মিউচুয়াল ফান্ড-১ (৫) এনসিসিবিএল মিউচুয়াল ফান্ড-১ এবং (৬) এমবিএল ফার্স্ট মিউচুয়াল ফান্ড।

বিএসইসি সূত্রে জানা গেছে, গঠিত তদন্ত কমিটি এলআর গ্লোবালের ব্যবস্থাপনায় থাকা মিউচ্যুয়াল ফান্ডসমূহের নগদ ও নগদ সদৃশ সম্পদ এবং সিকিউরিটিজ বিক্রির অর্থ আত্মসাৎ ও পাচার হয়েছে কি-না তা তদন্ত করে দেখবে। একইসঙ্গে ফান্ডগুলোর তহবিলের মেয়াদকালে কী পরিমাণ ভূয়া আয় হয়েছে এবং কোন সময়ে সেটা প্রতিবেদন করা হয়েছে তা নিরূপণ করবে। প্রতিষ্ঠাকাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত মিউচ্যুয়াল ফান্ডগুলো অতালিকাভুক্ত সিকিউরিটিজে কী পরিমাণ বিনিয়োগ করেছে তা খতিয়ে দেখবে।

এছাড়া ছয়টি মিউচ্যুয়াল ফান্ডের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অ্যাসেট ম্যানেজার সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (মিউচ্যুয়াল ফান্ড) বিধিমালা লঙ্ঘন করেছে কি-না যাচাই করে দেখা হবে।

বিগত সরকারের আমলে আইন বা বিধি-বিধান লঙ্ঘন করা মিউচুয়াল ফান্ডগুলোর বিরুদ্ধে তেমন কোনো কঠোর ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি। তবে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর পুনর্গঠিত বিএসইসির চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদের নেতৃত্বাধীন নতুন কমিশন মিউচুয়াল ফান্ডগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছে।

পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টদের মতে, এই অনুসন্ধান আদেশ এলআর গ্লোবালের কার্যক্রমে বড় ধরনের ধাক্কা দিতে পারে এবং দীর্ঘদিনের নানা গরমিল ও জবাবদিহিহীনতা উন্মোচনে সহায়ক হবে। বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সুরক্ষায় বিএসইসির এই পদক্ষেপকে তারা সময়োপযোগী বলে অভিহিত করেছেন।

বিএসইসির তদন্ত আদেশ
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন মনে করে, পুঁজিবাজার এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের বৃহত্তর স্বার্থে এলআর গ্লোবাল বাংলাদেশ অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি লিমিটেডের সিকিউরিটিজ বিধিবিধান পালনের মাত্রা নিরূপণের লক্ষ্যে তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করা প্রয়োজন।

এমতাবস্থায়, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অর্ডিনেন্স, ১৯৬৯ (১৯৬৯ সালের অধ্যাদেশ নং XVII) এর সেকশন ২১ এবং এবং বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন আইন, ১৯৯৩ এর সেকশন ১৭ক এর প্রদত্ত ক্ষমতাবলে তিনজন কর্মকর্তার সমন্বয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে অনুসন্ধান কার্যক্রম পরিচালনার নির্দেশ প্রদান করা হলো। তদন্ত কর্মকর্তাদের ৬০ কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত কার্যক্রম সম্পন্ন করে কমিশনে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন দাখিল করবে।

যেসব বিষয় খতিয়ে দেখবে তদন্ত কমিটি
এলআর গ্লোবাল ব্যবস্থাপনায় থাকা ছয়টি মিউচ্যুয়াল ফান্ডের প্রতিষ্ঠাকাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত ব্যাংক হিসাবের সব লেনদেন, জমা, সুদ ও অন্যান্য আর্থিক ভারসাম্যের বিবরণী সংগ্রহ করে তা যাচাই করা হবে। পাশাপাশি, এসব ফান্ড থেকে অ্যাসেট ম্যানেজার ও সংশ্লিষ্ট পক্ষদের অনিয়মিত অর্থপ্রদানের প্রমাণ থাকলে তা খুঁজে বের করা হবে। সিডিবিএল থেকে প্রাপ্ত লেনদেন রেকর্ড ও ব্যালান্স শিট পর্যালোচনা করে প্রতিবেদনে কোনো প্রকার আর্থিক অনিয়ম বা গরমিল আছে কিনা তা শনাক্ত করা হবে। এছাড়া, অ-তালিকাভুক্ত সিকিউরিটিজে বিনিয়োগের তারিখ, পরিমাণ, প্রকৃত রিটার্ন ও বর্তমান অবস্থা পর্যালোচনা করে জমা দিতে হবে বিস্তারিত প্রতিবেদন।

প্রতিটি অর্থবছরের শেষে লেনদেনযোগ্য সিকিউরিটিজে বিনিয়োগের অধিগ্রহণ খরচ, ন্যায্য মূল্য এবং ন্যায্য মূল্যের হ্রাসের জন্য প্রভিশনের ঘাটতি কতটুকু রয়েছে তা খতিয়ে দেখা হবে। পাশাপাশি, অ্যাসেট ম্যানেজার সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (মিউচ্যুয়াল ফান্ড) বিধিমালা, ২০০১ এর বিধি ৫৫ ও পঞ্চম তফসিল লঙ্ঘন করেছে কিনা তাও অনুসন্ধানে গুরুত্ব পাবে।

ডিভিডেন্ড ঘোষণা, বিতরণ ও অবিতরিত ডিভিডেন্ডের অবস্থা, পরিচালন ব্যয় বাবদ ব্যবস্থাপনা ফি, ট্রাস্টি ফি, কাস্টডিয়ান ফি, ব্রোকারেজ কমিশন ইত্যাদি খাতের ব্যয় পর্যালোচনা করে কোনো অযোগ্য বা অবৈধ ব্যয় চার্জ করা হয়েছে কিনা সেটিও খতিয়ে দেখা হবে। এমনকি, মিউচ্যুয়াল ফান্ডের জীবনচক্রে কোনো সময়ে ভুয়া আয় প্রতিবেদন করা হয়েছে কিনা, নগদ ও নগদ সদৃশ সম্পদ বা সিকিউরিটিজ বিক্রির অর্থ আত্মসাৎ কিংবা পাচারের মতো গুরুতর অভিযোগও তদন্তের আওতায় আনা হয়েছে।

এছাড়া এলআর গ্লোবালের গঠনতন্ত্র, সংঘবিধি, বিভিন্ন ফর্ম ও ডকুমেন্ট, এবং প্রতিষ্ঠাকাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত অনুষ্ঠিত সব বোর্ড সভা ও বার্ষিক সাধারণ সভার কার্যবিবরণী সংগ্রহ ও যাচাই করতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি, স্বতন্ত্র নিরীক্ষক, ট্রাস্টি, কাস্টডিয়ান এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য পক্ষ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থরক্ষা সংক্রান্ত বিধিবিধান যথাযথভাবে পালন করেছে কিনা তাও খতিয়ে দেখা হবে।

প্রসঙ্গত, গত ১৫ জুলাই অনুষ্ঠিত ৯৬৩তম কমিশন সভায় একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালে অবৈধভাবে ৪৯ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা অর্থ ফেরত আনার জন্য এলআর গ্লোবালকে বিএসইসি নির্দেশ দেয়। বিনিয়োগকৃত অর্থ সুদসহ ফেরত আনতে না পারলে ৬০ কোটি টাকা জরিমানা করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে এলআর গ্লোবালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক/প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা/প্রধান বিনিয়োগ কর্মকর্তা রিয়াজ ইসলামকে ৫০ কোটি টাকা জরিমানা করা হবে।

এছাড়া কোম্পানিটির পরিচালক জর্জ স্টককে ৪ কোটি টাকা, তৎকালীন লিগাল ও কমপ্লায়েন্স বিভাগের প্রধান মনোয়ার হোসেনকে ৪ কোটি টাকা, প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও) রোনাল্ড মিকি গোমেজকে ১ কোটি টাকা জরিমানা করা হবে। একইসঙ্গে এলআর গ্লোবালের পরিচালিত ডিবিএইচ ফার্স্ট মিউচুয়াল ফান্ড, গ্রিন ডেল্টা মিউচুয়াল ফান্ড, এআইবিএল ফার্স্ট ইসলামিক মিউচুয়াল ফান্ড, এলআর গ্লোবাল বাংলাদেশ মিউচুয়াল ফান্ড-১, এনসিসিবিএল মিউচুয়াল ফান্ড-১ ও এমবিএল ফার্স্ট মিউচুয়াল ফান্ডকে মোট ১ কোটি টাকা জরিমানা ধার্য করা হবে। এল আর গ্লোবাল বাংলাদেশ মিউচুয়াল ফান্ড ওয়ান এর অর্থ অপব্যবহারের অভিযোগে কোম্পানিটির কর্মকর্তা সাইদ কামরুল হুদার বিরুদ্ধেও তদন্ত করার নির্দেশ দেওয়া হয়।

এর আগে ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারিতে তহবিল পরিচালনাসংক্রান্ত বিধি ভঙ্গ ও বিভিন্ন অনিয়মের দায়ে এলআর গ্লোবাল অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিকে ৫০ লাখ টাকা জরিমানা করে বিএসইসি।